খুলনা মহানগরী থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবনঘেঁষা কয়রা উপজেলার প্রাচীন ইউনিয়ন আমাদি। মসজিদকুড় মসজিদটি এ উপজেলার আমাদি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের পূর্ব তীরে মসজিদকুড় গ্রামে অবস্থিত। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান। মসজিদটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ ও এর খুব কাছেই রয়েছে সুন্দরবন।

ইতিহাস
এ অঞ্চলটি বন ও বিভিন্ন গাছ-পালায় ভরপুর ছিলো। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর খননকার্য সম্পাদনা করে মাটির নিচের এই মসজিদটি আবিষ্কার করা হয়। মসজিদটি আবিষ্কারের সময় সেখানে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি বলে এর নির্মাণ-এর সময় সম্পর্কেও সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। মাটির নিচ থেকে খুঁড়ে মসজিদটি আবিষ্কৃত হয় বলে একে মসজিদকুঁড় নামে নামকরণ করা হয়েছিল। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মনে করেন, এ মসজিদটি খুব সম্ভবত খান জাহানের শাসনামলে তৈরি করা হয়েছিল।
আরো পড়ুন: লালবাগ কেল্লা
অবকাঠামো
৪৫ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত পুরো মসজিদটি বর্গাকার। মসজিদটির আয়তন ভিতরে ১২.১৯ মিটার এবং বাহিরে ১৬.৭৬ মিটার। বর্গাকার বহুগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি ইটের তৈরি। মসজিদটির প্রতিটি দেয়াল প্রায় ৭ ফুট প্রশস্ত। বর্গাকারে নির্মিত মসজিদটির হয়েছিল বাইরের ও ভেতরের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৫৪ ও ৩৯ ফুট। মসজিদটির সামনে রয়েছে তিনটি দরজা ও অভ্যন্তরে রয়েছে পাথরের তৈরি চারটি স্তম্ভ। দেয়াল ও স্তম্ভ মিলিয়ে তিনটি সারিতে তিনটি করে মোট ৯টি গম্বুজ রয়েছে।
বাইরের চারকোণের গোলাকার বুরুজ ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। কিবলা প্রাচীর ব্যতীত অন্য তিন দিকের প্রতি দিকে রয়েছে তিনটি করে খিলানযুক্ত প্রবেশপথ। তিনটি খিলানের কেন্দ্রীয়টি পার্শ্ববর্তী দুটি থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। পূর্ব দিকের খিলানযুক্ত প্রবেশপথের সাথে মিল রেখে কিবলা প্রাচীরে রয়েছে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব-কুলুঙ্গি। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি একটু বড় এবং পেছনের দিকে প্রসারিত। ভবনের কার্নিস সামান্য বক্র। মসজিদের অভ্যন্তরভাগ চারটি প্রস্তর স্তম্ভ দ্বারা নয়টি সমমাপের বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত, প্রতিটি বিভাগ উল্টানো পেয়ালা সদৃশ গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। প্রস্তর-স্তম্ভের উপর স্থাপিত খিলানের উপর গম্বুজগুলি স্থাপিত। খিলানগুলির পাশের কোণা ভরাট করা হয়েছে ইটের নির্মিত পেন্ডেন্টিভ দ্বারা।
আদি অবস্থায় এ মসজিদে পোড়ামাটির প্রচুর অলঙ্করণ ছিল। মসজিদের অভ্যন্তরে মুক্তভাবে দণ্ডায়মান প্রস্তর-নির্মিত চারটি স্তম্ভ আছে। স্তম্ভগুলোর উপরে কৌণিক খিলান ও নয়টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটি মূলত পোড়ামাটির ফলকে অলঙ্কৃত ছিল, যা খিলান পথের স্প্যান্ড্রেল এবং মিহরাব কুলুঙ্গিতে এখনও বিদ্যমান। বিভিন্ন অলঙ্করণ নকশার মধ্যে ফুল, জালির কাজ, হীরাকৃতি এবং প্রবহমান লতাপাতা উল্লেখযোগ্য।
মসজিদের সম্মুখভাগ
পূর্বদিকের কৌনিক খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। খিলানগুলোর ওপরের দিক অলঙ্করণযুক্ত। উত্তর দিকের প্রবেশ পথটির উপরে আনুভূমিক এক সারি মোল্ডিং আছে। তার ওপর আনুভূমিক আরও এক সারি পুষ্প অলঙ্করণ আছে। কেন্দ্রীয় খিলানটির উপরাংশ অধিক অলঙ্কৃত। এই খিলানটির দুই পার্শ্বই ক্ষতিগ্রস্ত। খিলানটির উত্তর পাশে শুধু একটি পুষ্প অলঙ্করণ দেখা যায়। মধ্যবর্তী খিলানের ওপর আনুভূমিক এক সারি পেঁচানো নকশা এবং তার ওপর আনুভূমিক আরও একসারি মোল্ডিং রয়েছে। তার ওপর রয়েছে আনুভূমিক এক সারি বুনানো নকশা। তার ওপর রয়েছে আরও এক সারি মোল্ডিং। সবার ওপরে একটি খাঁজের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র মিহরাব রয়েছে। মিহরাবটির দুই দিকে দুটি ক্ষুদ্র স্তম্ভ ও ওপরে একটি কৌনিক খিলান রয়েছে। মসজিদটির সম্মুখ অংশের দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথটির ওপরের খিলানের দুই পাশে এবং খিলানটির ওপরে অলঙ্করণ আছে। সম্মুখ অংশের উত্তর ও দক্ষিণের প্রবেশ পথগুওলার ওপর পুষ্প অলঙ্করণ আছে। কোনো কোনো অলঙ্করণ বৃত্তাকার স্থানে অবস্থিত। সবার ওপরে একসারি পুষ্প অলঙ্করণের ওপর রয়েছে ধনুক-বক্র ছাদ কিনারা । দুই কোনার বুরুজগুলোতে আনুভূমিক সারিতে বন্ধনী রয়েছে। এখানে জালের নকশাও আছে।
উত্তর ও দক্ষিণ দিক
এ মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে তিনটি করে কৌনিক খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ রয়েছে। মধ্যবর্তী প্রবেশ পথটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ। মধ্যবর্তী এ খিলানটির ওপরে আনুভূমিক সারিতে মোল্ডিং ও অলঙ্করণ রয়েছে। তিনটি খিলানের ওপরই পুষ্প অলঙ্করণ রয়েছে।
কিবলা দেওয়াল (বহির্ভাগ)
কেন্দ্রীয় মিহরাব অংশটি বাইরের দিকে উদ্গত। এর দু’দিকে খাঁজ রয়েছে।
ধনুক-বক্র ছাদ কিনারা
এ মসজিদের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে ধনুক-বক্র ছাদ কিনারার নিচে আনুভূমিক এক সারি জাল-নকশা রয়েছে। এটি সম্মুখ অংশের দিকে কিছুটা সম্প্রসারিত।
মসজিদের প্রার্থনা-কক্ষ
পূর্বদিকের কৌনিক খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশ পথ দ্বারা বর্গাকার এই প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশ করা যায়। বর্গাকার চারটি স্তম্ভের ওপর কৌনিক খিলান এবং তার ওপর নয়টি গম্বুজ স্থাপিত। গম্বুজগুলোর নিচে চার কোনায় কোনাকুনি ও আড়াআড়িভাবে পর্যায়ক্রমে স্থাপিত ইটের তৈরি পেন্ডেন্টিভ আছে। প্রবেশ পথগুলোর ভেতরের দিকে পোড়ামাটির অলঙ্করণ আছে।
কিবলা দেওয়াল (অভ্যন্তর ভাগ)
মসজিদটির অভ্যন্তরভাগে কিবলা দেওয়ালে অর্ধবৃত্তাকার তিনটি মিহরাব আছে। মিহরাবগুলোর অভ্যন্তরে আনুভূমিক সারিতে মোল্ডিংয়ের বন্ধনী ও পোড়ামাটির অলঙ্করণ আছে। তিনটি মিহরাবই আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে আবদ্ধ। তিনটি মিহরাবের ওপরই বিভিন্ন ধরনের অলঙ্করণ আছে।
অন্য মসজিদের সাথে তুলনা
এখন পর্যন্ত এখানে কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি, তবে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ ও মসজিদকুড়ের নয়গম্বুজ মসজিদের গঠন প্রণালী ও স্থাপত্যে সাদৃশ্য থাকায় এটি খানজাহান আলী (রহ.) কর্তৃক নির্মিত বা তার সমমায়িক বলে ধারণা করা হয়। আমাদির মসজিদকুড় মসজিদের নকশার সাথে বাগেরহাটের খানজাহান আলী (রহ.) নির্মিত ইমারতগুলোর নকশা মিল রয়েছে। প্রাচীন মসজিদ হিসেবে এর নির্মাণশৈলী চমৎকার। মনে করা হয়, খান জাহানের প্রতিনিধি হিসেবে খলিফাতাবাদ এর দক্ষিণ-পশ্চিম নিচু এলাকা শাসন করতেন। খুব সম্ভবত বুড়া খাঁ ও ফতে খাঁর তত্ত্বাবধানে মসজিদকুড় মসজিদ নির্মিত। মসজিদের দক্ষিণে এই দুই কর্মকর্তার কাচারি এবং সমাধি ছিল বলে ধারণা করা হয়। এখন এই অংশের বেশির ভাগই কপোতাক্ষ নদের বুকে নিমজ্জিত।
কয়রা উপজেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
- কাটকাটা পর্যটন কেন্দ্র
- কেওড়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র