খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে খুলনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি বাংলাদেশর একমাত্র রাজনীতি মুক্ত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি গেজেটে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরকারি সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর ৪টি পাঠ্য বিষয়ের ৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে।বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ টি স্কুল ও ২ টি ইন্সিটিউট এর অধীনে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার জন এবং প্রতিবছর ২৮ টি পাঠ্য বিষয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। খুলনা শহরে থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছাকাছি আসার জন্য এটি খুলনা শহরের অনন্য জায়গা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে পাবেন
১. কালজয়ী মুজিব

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) ক্যাম্পাসে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মুর্যাল ‘কালজয়ী মুজিব’। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে প্রথম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত সুউচ্চ বঙ্গবন্ধুর এই মুর্যালটি এখন শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষের জন্য দর্শনীয় হয়ে উঠেছে।
দৃষ্টিনন্দন এ মুর্যালটির প্রতিরূপ বিনির্মাণ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কনক কুমার পাঠক। বেদিসহ ৩৮ ফুট উঁচু ও ৪৩ ফুট বিস্তৃত ‘কালজয়ী মুজিব’ নামাঙ্কিত এই শিল্প কর্মটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি, বিভিন্ন আকৃতির ৮টি স্তম্ভ ও ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ-উৎকীর্ণ একটি পেট এবং শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য একটি মঞ্চ। মাঝখানে একই আকারের ৬টি স্তম্ভ রয়েছে। এর ৬টি স্তম্ভ বাঙালী জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফার প্রতীক। কালো রঙের স্তম্ভটি শোকাবহ ১৫ আগস্টের স্মারক। এ স্তম্ভের শীর্ষে উৎকীর্ণ শিল্পকর্মটির নাম আর নিচের অংশে রয়েছে উদ্বোধন ফলক। লাল আভার স্তম্ভটি লম্বভাবে উপরে উঠে অনুভূমিকভাবে সকল স্তম্ভকে বেষ্টন করে একটি কারাগারের প্রতিকৃতি হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল সংগ্রামী জীবনে বার বার কারারুদ্ধ হবার বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিটি প্রতীকী কারাগারের বাইরের অংশে স্থাপন করে বুঝানো হয়েছে, কারাগারের লৌহকপাট তাঁর সংগ্রামী চেতনাকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি। জাতির পিতার প্রতিকৃতিটির পাশেই রয়েছে গ্রানাইট পাথরে উৎকীর্ণ ইউনেস্কো-স্বীকৃত বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ, ‘বাঙালীর অভূতপূর্ব জাগরণের বিশুদ্ধ সংগীত’ বঙ্গবন্ধুর ‘৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ’। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ-কালের পরিধি পেরিয়ে সকল শোষিত, বঞ্চিত, মুক্তিকামী মানুষের পথপ্রদর্শক। এ শিল্পকর্মের তাই নাম দেয়া হয়েছে ‘কালজয়ী মুজিব’।
২. অদম্য বাংলা

অদম্য বাংলা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ভাস্কর্য। এর স্থপতি শিল্পী গোপাল চন্দ্র পাল। ২০১১ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হলেও তা ২০১২ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয়। আধুনিক দৃষ্টিনন্দন ২৩ ফুট উচ্চতার মুক্তিযুদ্ধের এ ভাস্কর্যটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৪২ লাখ টাকা। ভাস্কর্যটির মূল অংশে স্থাপিত হয়েছে একজন নারীসহ বলিষ্ঠ ও তেজোদীপ্ত চার মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি, যা বাঙালি জাতির শৌর্য-বীর্যের মূর্ত প্রতীক। ভাস্কর্যটি মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মানুষের তথা নারী-পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্মিলিত ভূমিকার প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। বেদির চারদিকের ম্যুরালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, জাতীয় চার নেতার প্রতিকৃতি, বধ্যভূমির বর্বরতা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র পোড়া মাটির ফলকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
৩. খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় লেক

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক পেরিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে সৌন্দর্যের লীলাভূমি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিন লেক যা প্রথম দর্শনে সুন্দরবন বলেই মনে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে লেকটি ‘মিনি সুন্দরবন’ নামে পরিচিত। দুই পাশে সুন্দরী বৃক্ষের সারি আর মাঝখানে লেকের সবুজ জলরাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। তাইতো সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ অবসর সময় কাটাতে ছুটে আসে মনোমুগ্ধকর এই ক্যাম্পাসে। প্রকৃতি প্রেমীরা এখানে ছবি তুলতে তুলতে মিশে যান প্রকৃতির সাথে। বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মিত হয়েছে এই লেককে কেন্দ্র করে।
৪. শহিদ মিনার

৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও ভাষা শহিদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই চেতনা জাগিয়ে রাখতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুবি) নির্মিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ দেশের অন্যান্য স্থানের শহীদ মিনারের যে আদল রয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা তা থেকে অনেকটা ব্যতিক্রমী। শহীদ মিনারটির দৈর্ঘ্য ৩৮ ফুট ও প্রস্থ ৩৫ ফুট। ভূমি থেকে ৩২ ফুট উচ্চতার এই শহীদ মিনারের বেদীর দিকে মুখ করা আছে মাতৃভাষার জন্য দেশের শহীদ সন্তানদের উৎসর্গীকৃত রক্তের আখরে লেখা মুক্তির মাধ্যম কলম। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া বর্ণনামতে, কলমের নিবের মাথায় চৌকনিক একটি ফোটা (ড্রপ) যুক্ত হয়েছে। যা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বেদনার অশ্রুবিন্দু এবং একই সঙ্গে জ্ঞান সৃজনের অন্তর্নিহিত শক্তি প্রতিভাত হয়েছে। কলমটি একটি খোলা চোখের গোলাকার আকৃতির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছে। স্থাপত্য ডিজাইনে এই কলমে চির জয়ের ছবি, ভাষ্য ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টি প্রতিফলিত হয়েছে।
শহীদ মিনারে ল্যান্ডস্কেপিংয়ে কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি চাতালে পর্যায়ক্রমে ওঠার জন্য ৮টি ধাপ রয়েছে। যাতে আমাদের ভাষা আন্দোলনের পর্যায়ক্রমিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অনেকটা ত্রি-কোন আকৃতির শহীদ মিনারের নিচের অংশে আরও বেশ কিছু শৈলী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ গোলাম আলী ফকির। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. এস এম নজরুল ইসলাম। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষে ২০০০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি এ শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। ২০০১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আশপাশের এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এখানে শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু করে। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ সম্পাদন শেষে ২০০৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মাহবুবুর রহমান।
৫. কটকা স্মৃতি সৌধ

কটকা ট্র্যাজেডি স্মরণে ১৩ মার্চ রবিবার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক দিবস পালন করে। ২০০৪ সালের এ দিনে সুন্দরবনের কটকা নামক স্থানে সফরে গিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের ৯ জন এবং বুয়েটের ২ জনসহ মোট ১১ জন ছাত্র-ছাত্রী সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত হয়ে শাহাদতবরণ করেন। সেই শিক্ষার্থীদের স্মৃতির স্মরণে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে এই কটকা স্মৃতি সৌধটি।
৬. বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ

নান্দনিকতায় অনন্য খুবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ১৪৫০০ বর্গফুট আয়তনের একতলার এক গম্বুজ বিশিষ্ট। এ গম্বুজটি খুলনাঞ্চলের সর্ববৃহৎ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আবদুল কাদির ভূঁইয়া ২০০৩ সালে এ মসজিদটির নির্মাণের উদ্যোগ নেন। স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের তৎকালীন শিক্ষক মুহাম্মদ আলী নকী মসজিদটির প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. ফায়েক উজ্জামান মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন।






কিভাবে যাবেন
খুলনা শহর থেকে ৩ কিমি পশ্চিমে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক সংলগ্ন ময়ুর নদীর পাশে গল্লামারিতে অবস্থিত। শহরের ডাকবাংলা মোড়, সোনাডাঙ্গা, রূপসা, নিউমার্কেট প্রভৃতি জায়গা থেকে ইজিবাইকে সহজে যাওয়া যায়। বিভিন্ন স্থান হতে ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা দিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত যাওয়া যায়। এছাড়া রিক্সাযোগেও যাওয়া যায়।
কোথায় খাবেন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়াতে দুপুরে ভাত, ডাল, মাছ, মাংস এবং হালকা নাস্তা পাওয়া যায়। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খান জাহান আলী হল, খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ হল সংলগ্ন কিছু মাঝারি ও উন্নত মানের খাবার হোটেল গড়ে উঠেছে। এসব জায়গা থেকে খাবার খেতে পারেন। এছাড়া নগরীর জিরো পয়েন্টে চুইঝাল মিশ্রিত গরুর মাংস, খাসির মাংস, মাছ, ডাল এসব খাবার খেতে পারেন।
খুলনার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
- খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর
- হাদিস পার্ক
- খান জাহান আলী সেতু
- বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধি
- কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট
- দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স
- ওআইসি রিসোর্ট
- খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
- খুলনা জাহানাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পার্ক (গিলাতলা পার্ক/বনবিলাস)
- জাতিসংঘ শিশু পার্ক
- গল্লামারী লিনিয়ার পার্ক
- শেখ রাসেল ইকোপার্ক
- রানা রিসোর্ট অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক
- সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক
- শিরোমণি স্মৃতিসৌধ
- ভুতিয়ার পদ্মবিল
- পিঠাভোগ, বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসতভিটা
- ধামালিয়া জমিদার বাড়ি
- প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বাড়ি
- কাটকাটা পর্যটন কেন্দ্র
- কেওড়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র
- মসজিদকুঁড় মসজিদ
বিশেষ সতর্কতা
হোটেল, রিসোর্ট, যানবাহন ভাড়া ও অন্যান্য খরচ সময়ের সাথে পরিবর্তন হয় তাই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য বর্তমানের সাথে মিল না থাকতে পারে। একারণে কোন স্থানে ভ্রমণের পূর্বে বর্তমান ভাড়া ও খরচ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিবেন। ওয়েবসাইটে যোগাযোগের সুবিধার্থে প্রদত্ত নাম্বারে কোনরূপ আর্থিক লেনদেনের আগে যাচাই করার অনুরোধ করা হলো। কোন আর্থিক ক্ষতি বা কোন প্রকার সমস্যা হলে তার জন্য চলো ঘুরি কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।