চকরিয়া উপজেলার এর দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ

0
124
ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক

চকরিয়া উপজেলার অবস্থান উত্তর অক্ষাংশের ২১৫৬ থেকে ২১৩৪ এর মধ্যে এবং দ্রাঘিমাংশের ৯১৫৬ থেকে ৯২১২ এর মধ্যে অবস্থিত। চকরিয়ার উত্তরে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী ও লোহাগাড়া উপজেলা; দক্ষিণে কক্সবাজার জেলার সদর কক্সবাজার উপজেলা, রামু উপজেলা ও মহেশখালী চ্যানেল; পূর্বে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা; এবং পশ্চিমে কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলা ও মহেশখালী চ্যানেল অবস্থিত।

চকরিয়া’ নামের উৎপত্তি নিয়ে একাধিক জনশ্রুতি বা মতান্তর  রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাতামুহুরী নদীর চারটি বাক বা মোড় থেকে বাকচতুষ্টয় বা চক্রবাক, কারো মতে আকাশে প্রচুর চকুরী পাখির বিচরণ থেকে চকরিয়া নামকরণ হয়েছে। ত্রিপুরা রাজাদের বিখ্যাত “রাজমালা” গ্রন্থে “চাকরোয়া” নামের একটি গ্রামের উল্লেখ পওয়া যায়। এই চাকরোয়া থেকেই চকোরিয়ার নামের উৎপত্তির হয়েছে বলে মনে করা হয় । ধারণা করা হয় যে, বর্তমান কাকারা ইউনিইয়নে কোন এক সময় “চাক” নামের একটি আদিবাসি জাতির বসবাস ছিল যাদের অস্তিত্ব একমাত্র বর্তমান বান্দারবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বিদ্যমান। উপজাতিরা সাধারণত গ্রামকে “রোয়া” বলে। সেই অনুসারে  চাক জনগোষ্টির বসবাসকৃত গ্রামটির নামকরন হয়েছে ‘চাকরোয়া’। এই চাকরোয়া থেকেই ‘চকরিয়া’র নামকরণ করা হয়।

১। শাহ্ ওমরের মাজার (কাকারা)

চকরিয়ার একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান কাকারা ইউনিয়নের শাহ ওমর মাজার । শাহ্ উমর ইন্তেকাল করলে খানকাহ্ মসজিদের পাশাপাশি গড়ে তোলা হয় শাহ ওমরের (র.) মাজার শরীফ। কক্সবাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং পবিত্রতম স্থান হিসেবে শাহ ওমরের মাজার পূণ্যার্থী ও ভক্তদের কাছে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় অনুভূতির ত্রিমুখী চেতনায় কাকারা শাও ওমরের মাজার চকরিয়ার প্রাচীন কৃষ্টি ও মুসলিম সভ্যতার অন্যতম । মাজারের পুকুর গুলোতে রয়েছে বিশাল আকৃতির অসংখ্য গজাল মাছ। এগুলো সাধারণত কেউ খায় না, মাছ গুলাকে পূণ্যার্থী ও ভক্তরা খাওয়ায়। প্রায়  ৬০ একর জমি ব্যাপী বিস্তৃত এলাকায় মুসলিম কৃষ্টিতে নির্মিত মাজার , মাজার সংলগ্ন মসজিদ । ৪ টি বড় পুকুর পুরো এলাকাটিতে ধর্মীয় আবহের পবিত্রতার সাথে প্রাকৃতিক মুগ্ধতার অনুস্বর করে রেখেছে। মাজারে স্বর্গীয় অনুভূতির  প্রশান্তিতে মন-প্রান ভরে উঠে।

প্রতিদিন শাহ ওমরের মাজারের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ আসেন, বিশেষ করে শুক্রবারদিন আসেন বেশি। মাজারে এসে শাহ ওমরের দরবারে বিভিন্নজন বিভিন্ন কারণে গরু, ছাগল-মুরগী ইত্যাদি মানত করেন। তাদের বিশ্বাস শাহ ওমরের দোয়ায় তাদের সেসব আশা পূরণ হয়। অনেকে আত্মীয়-পরিজনদের নিয়ে একত্রে বসে খাবার মানত করেন।

২। ফজল কুকের তিন গম্বুজ মসজিদ

মানিকপুর তিনগম্বুজ মসজিদ হল কক্সবাজার জেলার একটি অনন্য স্থাপত্যশৈলী সমৃদ্ধ শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ। এই মসজিদে তিনটি গম্বুজ ও বারটি খিলান রয়েছে। মানিকপুর মসজিদটি একটি অনন্য স্থাপত্যশৈলী এবং ঐতিহাসিক শিল্পমূল্য সমৃদ্ধ স্থাপন। এটি গঠিত হয়েছিল চকরিয়ার মানিকপুরে এবং এখনও সগর্বে টিকে আছে। মসজিদটি মাতামুহুরী নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত এবং পাহাড়ের নৈসর্গিক পরিবেশে অবস্থিত। কক্সবাজার জেলার পর্যটনের একটি সম্পদ মানিকপুর তিনগম্বুজ মসজিদ। প্রতিবছর এখানে হাজার হাজার পর্যটক আসে এবং মসজিদটি প্রাচীনত্ব এবং বিশেষ স্থাপত্যসমৃদ্ধতার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের অংশ হতে পারে। স্থানীয়রা দাবি করেন যে, কক্সবাজার জেলায় এই ধরনের স্থাপত্য সমৃদ্ধ মসজিদটিকে ‘জাতীয় ঐতিহ্য’ ঘোষণা করে সংরক্ষণ ও সংস্কারের প্রয়োজন ।

এলাকার স্থানীয় ইতিহাসবিদদের তথ্য অনুযায়ী প্রতিষ্ঠাতা ফজল কিউক চৌধুরী এই মসজিদটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে প্রতিষ্ঠা করেন।

৩। ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক

সাফারি পার্কটি কক্সবাজার জেলা সদর হতে ৪৮ কিলোমিটার উত্তরে এবং চকরিয়া থানা থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এটি কক্সবাজার জেলা সদরের দক্ষিণ বন বিভাগের ফাসিয়াখালি রেঞ্জের ডুলাহাজারা ব্লকে অবস্থিত। আপনি ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক যেতে চাইলে ঢাকা থেকে যে কোন বাস, যেমন সৌদিয়া পরিবহন, এস.আলম পরিবহন, সেন্টমাটিন পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, হানিফ পরিবহন বা মর্ডাণ পরিবহন ব্যবহার করতে পারেন। আপনি চাইলে পারেন। চট্টগ্রাম থেকে সাফারি পার্কে পৌঁছানোর জন্য আপনাকে কক্সবাজার শহর হতে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা কিংবা মাইক্রোবাস অথবা পাবলিক বাস ব্যবহার করতে পারেন। পার্কের প্রবেশ মূল্য মাত্র ৳৫০ (পঞ্চাশ টাকা)।

কক্সবাজার জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপরূপ লীলাভূমি। এই জেলা পাহাড়, পর্বত, ঝার্ন্না এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের দিয়ে ঘেরা। চকরিয়া উপজেলা এই জেলার অংশে অবস্থিত এবং দুলাহাজারা সাফারী পার্ক সংরক্ষিত একটি বন এলাকা। এটি ১৯৮০-৮১ সালে হরিন প্রজনন কেন্দ্র হিসাবে চালু হয়। বর্তমানে এটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুর নির্ভয় আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

যা যা দেখতে পাবেন:                                                                            

সাফারী পার্ একটি সুপরিচিত প্রাকৃতিক পার্ক, যা নির্জন উঁচু নিচু টিলা, প্রবাহমান ছড়া, হ্রদ, বিচিত্র গর্জন গাছের মত সু-উচ্চ ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক বৃক্ষ চিরসবুজ বনের জানা-অজানা গাছ-গাছালি, ফল-ভেষজ উদ্ভিদ, লতার অপূর্ব উদ্ভিদের সমাহার ও ঘন বন নিয়ে গড়ে উঠেছে। এই পার্কের ছায়া ঘেরা পথ, সবুজ বনানী, জানা-অজানা গাছের সারি, পাখি আর বানরের কিচিরমিচির সবকিছু মিলিয়ে একটি অসাধারণ অনুভূতি সৃষ্টি হয়। আপনি পথের ধারে উচু ওয়াচ টাওয়ারে দাড়িয়ে দেখতে পাবেন পুরো পার্কের সীমানা পর্যন্ত অপার সৌন্দর্য। পার্কের চারদিকে বেষ্টনী রয়েছে যাতে বন্যপ্রাণী পার্কের বাইরে যেতে না পারে। পার্কের ভিতরে আভ্যন্তরীণ বেষ্টনীও রয়েছে। আভ্যন্তরীণ বেষ্টনীর ভিতরে বাঘ, সিংহ, হাতি, কুমির সহ বিভিন্ন প্রাণী অবস্থান করে ।

প্রধান ফটকের বাম পাশে ডিসপ্লে ম্যাপে সাফারী পার্কের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জানতে পারেন। পার্কের ভিতরে পর্যটকদের বাঘ, সিংহ এবং অন্যান্য প্রাণী দেখতে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এবং প্রহরা পোষ্ট রয়েছে। পার্কে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে এবং আপনি বাসে করে পুরো পার্কটি ঘুরে দেখতে পারেন। তবে পার্কটি পায়ে হেটে ঘুরে দেখা উত্তম। পার্কে প্রবেশ পথের হাতের বাম এবং ডান পাশ দিয়ে দুটি রাস্তা চলে গেছে। বাম পাশের রাস্তাটি ধরে হাটলে পার্কটি পুরোপুরি ঘুরে দেখা যায় এবং অনায়েসেই ডান পাশের রাস্তাটি দিয়ে বের হওয়া যায় ।

৪।  হাঁসের দীঘি

বৃহত্তর ঈদগাঁও এলাকার ঐতিহ্যবাহী দীঘি হলো মাতৃস্নেহের মতো একটি পরিবেশ যা স্থানীয় জনসাধারণের জীবনের তাগিদ পূর্ণ করে এবং দেশীয় মাছের প্রজনন ও অভয়ারণ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সেইসঙ্গে দীঘি একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থান যা বাস্তুসংস্থান রক্ষা, দেশীয় মাছের ভাণ্ডার ও প্রজননক্ষেত্র, প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর রক্ষা, বৃষ্টির পানির সংরক্ষণাধার এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখন দীঘি ঘিরে থাকা পাখপাখালি ও প্রাণিবৈচিত্র হারিয়ে গেছে, এবং দীঘিটি বৃহত্তর ঈদগাঁও’র ঐতিহ্যবাহী জলাধার এবং বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছের প্রজননক্ষেত্রও হতে শুরু করেছে।

৫। বীর কমলা দীঘি

কমলা দেবীর নামে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের বীর কমলার দিঘির নামকরণ হয়। ছয় একর জায়গাজুড়ে এই দিঘি দূরদূরান্ত থেকে দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা। তাঁরা নৌকা নিয়ে দিঘিটি ঘুরে দেখেন। কমলা দেবী ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা ধন্য মানিক্যের স্ত্রী। ধন্য মানিক্য ১৪৬৩-১৫১৫ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা ছিলেন।

প্রচলিত আছে, ধন্য মানিক্যের সৈন্য বাহিনী বীর কমলার দিঘি খননের সময়ে পানি পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন কমলা দেবী দিঘিতে নামলে মাঝখানে পানি উঠতে শুরু করে। এ কারণে দিঘিটি তাঁর নামে করা হয়। কথিত আছে, দিঘির মাঝখানের অংশটি কখনো শুকায় না। এই দিঘি থেকে স্থানীয় লোকজন পানি সংগ্রহ করে রোগের প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহার করে।

৬ । মেধা কচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান

মেধা কচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত একটি জাতীয় উদ্যান। এই বনটি তার সুবিশাল মান্দার গর্জন গাছের জন্য সুপরিচিত। মেধা কচ্ছপিয়া একটি প্রাকৃতিক বন। ২০০৪ সালে উদ্যানটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষিত হয় । এই জাতীয় উদ্যানের আয়তন প্রায় ৩৯৫.৯২ হেক্টর।

এখানকার বনের প্রকৃতি হলো ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বন। এ উদ্যানটি কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন। পার্কটির ১ থেকে ৩ কিলোমিটারের মধ্যে আনুমানিক ১৮৩০৫ জন লোকের ৩৫২৩টি পরিবার বসবাস করে। এসব স্থানীয় গ্রাম কিংবা পাড়া গুলো মূলতঃ কৃষিকাজ, লবণ চাষ ও মৎস্য চাষের উপর নির্ভরশী

জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল শতবর্ষী গর্জন বনকে রক্ষা করা। এই অঞ্চলে কিছু ছোট গর্জন বন এখনও উন্নয়নশীল থাকছে। এই বনগুলির মধ্যে জাতীয় উদ্যানের প্রধান বৃক্ষরাজি সহ ঢাকিজাম, ভাদি, তেলসুর ও চাপালিশ উন্নয়নশীল রয়েছে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-মহাসড়ক সংলগ্ন এ পার্কটিতে চট্টগ্রাম কিংবা কক্সবাজার হতে সড়ক পথে সহজেই আসা যায়।

৭। ইলিশিয়া জমিদার বাড়ি

চকরিয়া উপজেলার পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি হল ইলিশিয়া জমিদার বাড়ি যা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত। এই জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠার সাল সম্পর্কে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে জানা গেছে যে এই জমিদার বাড়ির বংশধররা মুসলিম ছিলেন। এখনো উক্ত জমিদার বাড়িতে বংশপরামপণায় বসবাস করে আসছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here